Recents in Beach

জাফর ইকবালের বই | জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস সমগ্র

 - 

টিশা বড় একটা কংক্রিটের টুকরাের উপর দাঁড়িয়ে বহুদূরে তাকিয়ে থেকে অনেকটা নিজের মনে গুনগুন করে একটা গান গাইছিল। তার গানের গলা অপূর্ব, কিন্তু এখানে দাঁড়ানাের ভঙ্গিটি খুবই বিপজ্জনক, মনে হচ্ছিল যে কোনাে মুহূর্তে বুঝি পড়ে যাবে। গান গাইতে গাইতে দূরে তাকিয়ে সে কী দেখছে কে জানে। দেখার কিছু নেই, যতদূর চোখ যায় শুধু লালচে মাটি, পাথর আর উঁচু-নিচু হয়ে থাকা বালিয়াড়ি। টিশা হঠাৎ করে গানটি শেষ করে ফেলল, তখন আমি বললাম, “টিশা সাবধান, পড়ে যাবে কিন্তু!” 

আমার কথা শুনে টিশা মনে হয় একটু মজা পেল। তাই আমাকে ভয় দেখানাের জন্য সে বিপজ্জনক ভঙ্গিতেই পাশের কংক্রিটের টুকরাের উপর একটা লাফ দিল। আমি রীতিমতাে চমকে উঠলাম, মুহূর্তের জন্য মনে হলাে সে বুঝি তাল হারিয়ে পড়ে যাবে। টিশা অবশ্যি পড়ে গেল না, নিজেকে সামলে নিয়ে আবার একটা বিপজ্জনক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসতে থাকে। আমি একটু বিস্ময় নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকি, তাকে আমি সেই ছেলেবেলা থেকে চিনি, কিন্তু সে যখন এভাবে খিলখিল করে সারা শরীর দুলিয়ে হাসে তখন হঠাৎ করে মনে হয় সে বুঝি টিশা নয়, সে বুঝি অচেনা একটি মেয়ে। 

টিশা হাসি থামিয়ে বলল, “তুমি এরকম হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?” 

৯ 

টিশার কথা শুনে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম কিন্তু সেটা বুঝতে দিলাম না, বললাম, “আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখার জন্য তুমি কখন পড়ে যাও—তখন আমার নিচে গিয়ে তােমার শরীরটাকে ঘাড়ে করে টেনে তুলে আনতে হবে।” 

টিশা চোখ নাচিয়ে বলল, “তােমার কোনাে ভয় নেই রিহি। আমি পড়ে যাব না।” 

আমি সাবধানে একটা কংক্রিটের টুকরাে থেকে আরেকটা টুকরােয় দিয়ে টিশার কাছে এসে দাঁড়ালাম। বাতাসে তার চুল উড়ছে, আমি সেই চুলের মৃদু ঘ্রাণ পেলাম। টিশা হাত তুলে দূরে দেখিয়ে বলল, “আমার সব সময় জানার ইচ্ছা করে ওইখানে কী আছে?” 

“কোনখানে?” 

টিশা অনির্দিষ্টের মতাে হাত নেড়ে বলল, “ওই তাে। ওই দূরে।” 

আমি বললাম, “কী থাকবে। কিছু নেই। বহুদূরে হয়তাে মানুষের আস্তানা আছে। সেখানে আমাদের মতাে মানুষ থাকে।” 

টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার খুব জানার ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে আমার কী ইচ্ছা করে জান?” 

“কী?” 

“একটা মােটর বাইকে করে বাইরে ঘুরে বেড়াই। দেখি কোথায় কী আছে?” 

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, “বল কী তুমি? বাইরে ঘুরে বেড়াবে? তুমি জান না বাইরে দস্যু গিজগিজ করছে। মাটিতে রেডিয়েশান। জন্তু-জানােয়ারের মিউটেশান হয়ে দানব হয়ে গেছে।” 

টিশা বলল, “জানি।” 

“তাহলে?” “আমি সব জানি, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।” 

আমি অবাক হয়ে বললাম, “বিশ্বাস কর না?” | টিশা মাথা নাড়ল, “নাহ্।” আমি প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম, “তুমি জান, তুমি এইসব কথা বলছ জানলে তােমাকে কী 

করবে?” 

১০ 

“জানি। আমাকে ডিটিউন করে দেবে। আমি তখন কিছু বুঝব। । আমাকে যেটা বলবে সেটা করব। আমাকে দিয়ে শহরের রাস্তা পরিষ্কার করাবে। ময়লা টেনে নেওয়াবে। আরও খারাপ খারাপ জিনিস করাবে।” 

“তাহলে?” টিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে কী?” “তাহলে এরকম কথা বলছ কেন?” 

টিশা হাসার মতাে ভঙ্গি করে বলল, “আমি কি কমিউনে বক্তৃতা দিয়ে বলছি? আমি শহরের প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে তােমাকে বলছি।” টিশা আমার বুকে ঠোকা দিয়ে বলল, “রিহিকে! তুমি কি আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবে?” 

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না। আমি করব না।” “তাহলে সমস্যা কী?” 

“আমাকে বললে কোনাে সমস্যা নাই। কিন্তু এরকম আজগুবি কথা বলার দরকার কী?” 

টিশা কোনাে কথা বলল না, ছােট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। আমি বললাম, “তাকিয়ে দেখাে, আমাদের পুরাে শহরটাকে প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কংক্রিটের টুকরাে ফেলে ফেলে প্রাচীরটা তৈরি করেছে। কত উঁচু প্রাচীর দেখেছ?” 

| টিশা নিচে তাকাল, তারপর বলল, “দেখেছি।” 

“বাইরে যদি বিপদ না থাকবে তাহলে প্রাচীর দিয়ে শহরটাকে ঘিরে রাখবে কেন?” 

টিশা বলল, “আমি তাে কেনাে বিপদ দেখি না।” 

আমি বড়মানুষের মতাে ভঙ্গি করে বললাম, “তুমি দেখ না মানে এই নয় যে বিপদ নেই। আছে, নিশ্চয়ই আছে।” 

টিশা হঠাৎ করে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের শহরের মাঝে বিপদ নেই?” 

“শহরের মাঝে?” 

“হঁ্যা, শহরের মাঝে? এই বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা শহরের মাঝে কোনাে বিপদ নেই?” 

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “কিসের বিপদ? আমরা তাে শহরে বেশ নিরাপদেই আছি।” | টিশা মুখ শক্ত করে বলল, “কুনিলের কথা মনে আছে? কুনিল কত হাসিখুশি ছেলে ছিল মনে আছে?” 

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “মনে আছে।” 

“আর এখন? কুনিলকে ডিটিউন করে দিয়েছে। সকাল থেকে রাত রােদবৃষ্টিতে রাস্তা পরিষ্কার করে। আমরা যখন পাশ দিয়ে হাঁটি আমাদের দিকে তাকায় না। যখন আমাদের দিকে তাকায় আমাদের চেনে না।” হঠাৎ করে টিশার গলাটা ভেঙে গেল, “কী দোষ ছিল কুনিলের?” 

আমি বললাম, “আমি জানি না। নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছিল। কুনিল। শুধু শুধু তাে একজনকে ডিটিউন করে না।” 

টিশা মুখ শক্ত করে বলল, “আমি বলব কুনিল কী করেছিল?” “কী করেছিল?” “প্রশ্ন করেছিল। কুনিল প্রশ্ন করেছিল।” “কী প্রশ্ন করেছিল?” 

“কী প্রশ্ন করেছিল সেটা মােটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়—কুনিল প্রশ্ন। করেছিল সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। এই শহরে কেউ কোনাে প্রশ্ন করতে পারবে না। প্রশ্ন করলেই ডিটিউন করে দেওয়া হবে।” 

আমি টিশার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, একটু পরে বললাম, “কুনিল তাে তার প্রশ্নের উত্তর পেয়েই যেত। আর এক বছর পরেই তাে ওর মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানাে হতাে।” 

টিশা আবার শব্দ করে হাসতে থাকে, আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম তার হাসিতে কোনাে আনন্দ নেই। টিশা যেভাবে হঠাৎ হাসতে শুরু করেছিল ঠিক সেভাবে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর মাথায় ক্রেনিয়াল লাগালে আমরা সব প্রশ্নর উত্তর পেয়ে যাব?” 

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন পাব না?” “যাদের মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়েছে তারা সবকিছু জানে?” 

“একশবার জানে। মনে আছে মাহার কথা? মাহা কি জেনারেটরের কিছু জানত? জানত না। এখন শহরের সব জেনারেটর মাহা দেখে-শুনে রাখে। নষ্ট হবার আগে ঠিক করে ফেলে।” 

| টিশা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “মাহার মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানাের আগে সে কী করত তােমার মনে আছে?” 

আমি আলাদা করে মনে করতে পারলাম না, বললাম, “কী করত?” 

“গান গাইত। দিনরাত গুনগুন করে গান গাইত।” 

গান গাওয়ার সাথে ক্রেনিয়ালের কী সম্পর্ক আমি বুঝতে পারলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, “গান গাইলে কী হয়?” 

“এখন মাহা গান গায় না। মুখ শক্ত করে জেনারেটর ঠিক করে।। জেনারেটর ছাড়া মাহা আর কিছু জানে না।” 

“তাতে কী হয়েছে?” 

টিশা একটু অধৈর্য গলায় বলল, “ক্রেনিয়াল লাগানাের আগে মাহা ছিল মানুষ। এখন মাহা একটা রােবট।” 

টিশার কথা শুনে আমি এবারে শব্দ করে হেসে উঠলাম। বললাম, “টিশা, তুমি এবারে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছ। মাহা মােটেও রােবট না। মাহা খুবই হাসিখুশি মানুষ।” 

টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যা। একটু বেশিই হাসিখুশি।” “মানে?” 

“একজন সত্যিকার মানুষের মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়। মাথায় ক্রেনিয়াল লাগালে তার কোনাে দিন মন খারাপ হয় না।” 

“সেটা দোষের কিছু?” 

“বিচুরিয়াস নামে একটা নেশা করার ড্রাগ আছে। সেটা খেলে খুবই আনন্দ হয়। তুমি বাকি জীবন প্রত্যেকদিন একটু করে বিচুরিয়াস খাবে? এই একটুখানি?” 

“কেন? ড্রাগ কেন খাব?” “তাহলে তােমার প্রত্যেকদিন খুব আনন্দ হবে।” 

Muhammod Zafar Iqba

টিশা কী বলতে চাইছে হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম, বললাম, “তােমার ধারণা মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানাে আর ড্রাগ খাওয়া এক জিনিস?” 

“যদি ক্রেনিয়াল লাগিয়ে একটা মানুষের স্বভাবটাই বদলে দেয় তাহলে আমার কাছে একই জিনিস।” | “কিন্তু কিন্তু” আমি কেন জানি বাক্যটা শেষ করতে পারলাম । যে কথাটি বলতে চাইছিলাম হঠাৎ করে মনে হলাে সেই কথাটা অর্থহীন কথা, গুরুত্বহীন কথা। 

| টিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু কী? বলাে?” 

আমি অনিশ্চিতের মতাে বললাম, “যদি মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়ে একটা মানুষকে হাসিখুশি মানুষে তৈরি করা যায়, ভালাে মানুষে তৈরি করা যায়, তাকে যদি নতুন কিছু শেখানাে যায় তাতে দোষের কী আছে?” 

| টিশা আঙুল দিয়ে তার মাথাটা দেখিয়ে বলল, “আমার এই মাথায় একশ বিলিয়ন নিউরন আছে। এই একশ বিলিয়ন নিউরন আমি আমার মতাে করে কন্ট্রোল করতে চাই। কোনাে যন্ত্র দিয়ে সেটা কন্ট্রোল করতে চাই না।” | মাথার ভেতরে একশ বিলিয়ন নিউরন আছে সেটা আমরা কেউ জানি না। টিশা জানে, কেমন করে জানে? 

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। টিশার দিকে তাকিয়ে আমি বুকের ভেতর কেমন জানি ভয়ের একটা কাঁপুনি অনুভব করি। কী 

বলছে এসব টিশা? | 

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আগে মানুষ স্কুলে যেত, কলেজে যেত, ইউনিভার্সিটিতে যেত, নতুন কিছু শিখত। যেটা জানত না সেটা গবেষণা করে জেনে নিত। কিন্তু এখন তাে সেই নিয়ম আর নেই। এখন তাে কেউ কিছু শেখে না। যখন বয়স ষােলাে হয় তখন তার মাথায় ক্রেনিয়াল লাগিয়ে যেটা দরকার সেটা শিখিয়ে দেয়।” 

| টিশা বলল, “আমি জানি।” 

“তাহলে? তাহলে তুমি যদি মাথায় ক্রেনিয়াল না লাগাও তুমি কিছু জানবে না। কিছু শিখবে না। অশিক্ষিত হয়ে থাকবে। মূখ হয়ে থাকবে।” 

| টিশা মাথা নাড়ল, বলল, “আমি অশিক্ষিত মূখ না। ভিডি টিউবে বই পড়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি।” 

আমি বললাম, “কিন্তু সত্যিকারের কিছু শেখনি। সত্যিকারের কিছু শিখতে হলে মাথায় ক্রেনিয়াল লাগাতে হয়।” 

টিশা বলল, “ সেটা সবাই বলে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।” “তাহলে তুমি কী বিশ্বাস কর?” 

টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি বিশ্বাস করি মাথায় ক্রেনিয়াল না লাগিয়ে শুধু বই পড়ে সবকিছু শেখা সম্ভব। তা ছাড়া আমার মনে হয়, কী হয় অশিক্ষিত আর মূখ হয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দিলে? কেন একটা যন্ত্রের হাতের পুতুল হয়ে বেঁচে থাকতে হবে?” 

আমি টিশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, বললাম, “তুমি এসব কী বলছ টিশা!” 

টিশা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তাে অন্য কাউকে বলছি না রিহি! তােমাকে বলছি। তােমাকেও কি আমার মনের কথাগুলাে বলতে পারব না?” 

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, “না না টিশা, কেন বলতে পারবে না। অবশ্যই বলতে পারবে। কিন্তু 

“কিন্তু কী?” 

“কিন্তু এই কথাগুলাে কেমন করে তােমার মাথায় এল? এগুলাে তাে খুব ভয়ের কথা।” 

“কথাগুলাে যদি আমার মাথার ভেতরে থাকে তাহলে কেউ জানবে না। যদি তুমি বলে না দাও! আমি জানি তুমি কখনাে বলবে 

—তাই কেউ জানতে পারবে না যে আমার মাথার মাঝে ভয়ের কথা ঘুর ঘুর করতে থাকে। যে আমার মাথার মাঝে কী কথা ঘুর ঘুর করে তাতে কিছু আসে যায় না রিহি! কিছু আসে যায় না।” | আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “একটা জিনিস জান টিশা?” 

“কী?” 

“একজন মানুষের মনের মাঝে কী কথা আছে সেটা কীভাবে কীভাবে জানি বের হয়ে যায়। তাই আমার খুব ভয় করে। তােমার 

মনের কথা যদি কমিউনের মানুষেরা টের পেয়ে যায় তাহলে তােমার খুব বিপদ হয়ে যাবে।” | টিশা হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে শুরু করে, তার সেই বিচিত্র হাসি যেটা শুনে আমার মনে হয় এই টিশাকে আমি চিনি না, তাকে আগে কখনাে দেখিনি। 

| আমি বললাম, “তুমি হাসছ কেন?” 

*এমনি। আমি তাে বােকা একটা মেয়ে তাই মাঝে মাঝে হঠাৎ বােকার মতাে হেসে ফেলি। 

আমি বললাম, “টিশা তুমি মােটেও বােকা একটা মেয়ে না। তাই আমার খুব ভয় হয়। তুমি বােকা হলে তােমাকে নিয়ে আমি একটুও ভয় পেতাম না।” 

| টিশা তার হাসি থামিয়ে দূরে তাকাল, সূর্যটা নিচে নেমে আসছে। আকাশে লালচে ধুলাে, তার ভেতর দিয়ে সূর্যটাকে কেমন জানি বিবর্ণ দেখাচ্ছে। টিশা কিছুক্ষণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “চলাে যাই।” 

বলে সে আমার জন্য অপেক্ষা না করে একটা কংক্রিটের টুকরাে থেকে আরেকটা কংক্রিটের টুকরাের উপর লাফিয়ে ছুটতে শুরু করে। আমি বললাম, “দাঁড়াও টিশা! এত জোরে ছুটে যেয়াে না, আমি তােমার মতাে এখানে এত জোরে ছুটতে পারি না।” 

টিশা আমার কথা শুনল না, লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতেই লাগল। আমি আর কী করব, আমিও তার পিছু পিছু ছুটতে লাগলাম। টিশার কাছাকাছি পৌঁছে বললাম, “টিশা! তােমাকে একটা কথা বলি?” 

“কী কথা?” 

“এই যে তুমি আমাকে এত সব কথা বলেছ সেগুলাে মাথা থেকে বের করে দিতে পারবে?” 

টিশা মাথা ঘুরিয়ে সূর্যটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঐ সূর্যটাকে তােমার কী মনে হয়?” 

সে আমার কথাটা না শােনার ভান করছে। আমি আবার বললাম, “টিশা! আমার কথা একটু শােনাে। তােমার মাথার ভেতর থেকে ঐ চিন্তাগুলাে দূর করে দাও।” 

টিশা বলল, “ঐ সূর্যটাকে দেখলে মনে হয় ওটা সুস্থ নয়, ওটার পচন ধরেছে।” 

আমি বললাম, “তুমি আমার কথা না শােনার ভান করছ কেন টিশা?”। 

| টিশা বলল, “এই কংক্রিটের টুকরােগুলাে কী কুৎসিত, তাই না রিহি? সুন্দর একটা প্রাচীর তৈরি না করে এক গাদা কংক্রিটের টুকরাে ফেলে দিয়ে একটা প্রাচীর কেন তৈরি করল?” 

আমি বুঝলাম টিশা আমার কথার উত্তর দেবে না, তাই আমি চুপ করে গেলাম। 

| সূর্যটা ডুবে যাবার পর আমি আর টিশা প্রাচীর থেকে নেমে আসি। ভাঙা ধসে যাওয়া দালান, ইট পাথর কংক্রিটের জঞ্জাল, জং ধরা ভাঙা যন্ত্রপাতি পার হয়ে আমরা শহরের ভেতর ঢুকি। শহরের পথে মাঝে মাঝে টিম টিম করে আলাে জ্বলছে, আধাে আলাে আধাে অন্ধকারে মানুষজন নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে। জনমানবহীন উঁচু দালানের কোথাও কোথাও আলাে জ্বলছে। দূরে ঘর ঘর শব্দ করে একটা জেনারেটর চলছে। এই শব্দটুকু না থাকলে পুরাে শহরটাকে একটা ভুতুড়ে শহর বলে মনে হতাে। কী মন খারাপ করা একটা পরিবেশ, আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। 

ঠিক তখন আমরা পথের পাশে একটা মানুষের মূর্তিকে দেখতে পেলাম। হাতে একটা মপ নিয়ে সে রাস্তা পরিষ্কার করছে, তার মাঝে কোনাে ব্যস্ততা নেই। মাটির দিকে তাকিয়ে সে মপ দিয়ে ঘষে ঘষে সব আবর্জনা দূর করছে। আমরা দেখলাম মানুষটার পাশে একজন মহিলা দাড়িয়ে তাকে কিছু একটা বলছে। আরেকটু কাছে যাবার পর আমরা মহিলার কথা শুনতে পেলাম, নিচু স্বরে বলছে, “বাবা কুনিল, একবার আমার দিকে তাকা। একবার আমার কথা শােন।” 

আবছা অন্ধকারে আমরা এতক্ষণ চেহারা দেখতে পাইনি। এবারে তাকে চিনতে পারলাম, মানুষটি কুনিল। কুনিলের পাশে তার মা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। একজন মানুষকে ডিটিউন করে ফেললে তার মস্তিষ্ককে মােটামুটিভাবে অচল করে দেওয়া হয়। তখন সে কাউকে চিনতে পারে না, নিজের মাকেও চিনতে পারে না। 

১৭ 

কুনিলের মা কাতর গলায় বলল, “বাবা কুনিল। কুনিল সােনা আমার।” 

| কুনিল খুব ধীরে ধীরে তার মাথা ঘুরিয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল, আবছা অন্ধকারে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু জানি কুনিলের শূন্য দৃষ্টিতে জীবনের কোনাে চিহ্ন নেই। 

কুনিলের মা বলল, “বাবা কুনিল। কুনিল। কুনিল সােনা। একবার একটা কথা বল। মাত্র একবার!” 

আমরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় শুনতে পেলাম কুনিল মুখ দিয়ে অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ করছে। সেই শব্দের কোনাে অর্থ নেই। একটি অবােধ পশু আর কুনিলের মাঝে এখন কোনাে পার্থক্য নেই। কুনিলের মা সেটা এখনাে মেনে নিতে পারেনি। 


Post a Comment

0 Comments